ধর্মতত্ত্ব অনেক বড় জিনিস, অন্তত বিজ্ঞান অপেক্ষা বড়। কিন্তু আজকের দিনে বিজ্ঞানীরা এর সবচেয়ে বড় বিরোধীতাকারী, তাদের বস্ততান্ত্রিক মতে শরীরের অতিরিক্ত আর কিছু নাই। শিক্ষিত বাঙ্গালীও বিজ্ঞান জানুক আর নাই জানুক বিজ্ঞানের প্রতি অসম্ভব ভক্তি। কিন্তু ধর্ম বড় বলে আমরা বিজ্ঞানকে ত্যাগ করতে পারি না, ধর্ম সত্য, বিজ্ঞানও সত্য।
ধার্মিকেরা স্বীকার করে আত্মা বলে শরীরের অতিরিক্ত কিছু আছে যা ধ্বংস হয় না। কিন্তু কিভাবে বুঝব?
‘আমি’ বললে যাকে বুঝায় সেই আত্মা। ‘আমি’ দুঃখিত হই, আমার সুখ হয়। এই আমি কে, শরীর ? কিন্তু শরীরের মৃত্যু হলে তখন আর সুখ-দুঃখের অনুভূতির কথা শোনা যায় না বা লক্ষণ দেখা যায় না। অথবা কেউ অপমান করলে শরীরের কিছু হয় না তারপরেও আমরা দুঃখিত হই। তাহলে দেহ দুঃখভোগ করে না, যে দুঃখ-সুখ ভোগ করে সেই ‘আমি’ বা আত্মা, আমার শরীর আমি নয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে দুনিয়ার কিছু জিনিস ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানা যায়, কিছু অংশ অনুমান, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানা যায় না।
আত্মা নিয়ে এ কথাগুলো সকল ধর্মেই আছে। হিন্দুধর্মে আরও আছে, ভিন্ন ভিন্ন জীবের আত্মা পরস্পর বিচ্ছিন্ন মনে হলেও আসলে পৃথক নয়, সকলে এক জাগতিক আত্মার অংশ, কেউ বন্ধনমুক্ত হলেই জাগতিক আত্মায় বিলীণ হয়।
বিজ্ঞান বলে আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ নাই। যখন প্রমাণ হয় না তখন অবিনাশী, জীবাত্মা, পরমাত্মা এসবের কোন মানে নাই। প্রত্যক্ষ প্রমানের অভাবে বিজ্ঞান তাই আত্মাকে খুঁজে পায় না। বিজ্ঞান সত্যানুসন্ধানী কিন্তু সাধ্যমত চেষ্টা করেও বিজ্ঞান আত্মাকে পায় না, কারণ বিজ্ঞানের ততদূর যাবার ক্ষমতা নাই। যার দৌড় যতদূর সে ততদূর যেতে পারে। প্রমাণের দড়ি বিজ্ঞানের কোমরে বাঁধা, প্রমাণের অতীত আত্মতত্ত্ব তাই বিজ্ঞানের বাহিরে । শ্রীমদ্ভগবতগীতার টীকাভাষ্যে বন্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন “যেখানে বিজ্ঞান পৌঁছে না, সেখানে বিজ্ঞানের অধিকার নাই, যে উচ্চধামের নিম্ন সোপানে বসিয়া বিজ্ঞান জন্মসার্থক করে, সেখানে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অনুসন্ধান করাই ভ্রম।” সেখান থেকে আরেকটা উদ্ধৃতি
” Our victorious science fails to sound one fathom’s depth on any side since it doesn’t explain the parentage of mind (soul). For mind was in truth before all science, and remains for ever, the seer, judge, interpreter, even father of all its systems, facts and laws.”
“যখন বিজ্ঞান একটি ধুলিকণার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না, তখন আত্মার অস্তিত্ব প্রমান করবে কিভাবে?”
বিজ্ঞানী বলবেন, প্রমাণের অতিরিক্ত মানুষ কিছু জানতে পারে না, আত্মার অস্তিত্বের যখন কোন প্রমাণ নাই, তখন আত্মা সম্পর্কে মানুষের কোন জ্ঞান নেই, হতে পারে না।
দার্শনিকদের মতে প্রত্যক্ষ এবং প্রত্যক্ষমূলক অনুমান কখনই মানুষের জ্ঞানের সীমা নয়। ইমানুয়েল কান্টের মতে, “বুদ্ধি বা যে শক্তির দ্বারা আমরা প্রত্যক্ষ জ্ঞান পাই, তার চেয়ে উচ্চতর আমাদের এক শক্তি আছে। যা বিচার করে পাওয়া যায় না, সেই শক্তির প্রভাবে আমরা তা জানতে পারি।”
বন্কিমের মতে মানসিক বৃত্তির সঠিক অনুশীলন হলে আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় এ জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ হয়, অর্থাৎ আপনা -আপনি হয়। তাঁর সময়কার ইন্টেলেকচুয়াল মাস্তান হাক্সলি, টিন্ডাল এদের সকল মানসিক বৃত্তি মার্ঝিত হয়নি বলে তিনি মনে করতেন।
সমগ্র ধর্মতত্ত্বে বিজ্ঞানের অবস্থান তাহলে কোথায়? গীতায় তিন ধরণের সাধনার কথা বলা আছে, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ এবং ভক্তিযোগ। নির্বাণ বা মুক্তির জন্য বিজ্ঞানের প্রয়োজন শুধু জ্ঞানযোগে, অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত ভৌতিক জগতকে নিজের মধ্যে এবং ঈশ্বরে দেখতে পাওয়া। সর্বমোট তিনটা বিষয় জানতে হবে, ভৌতজগত, নিজেকে এবং পরমেশ্বরকে। দার্শনিক কোঁতের মতে ভৌতিক জ্ঞান পাওয়া যাবে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জোতির্বিদ্যা এবং গণিতে ।
নিজেকে জানা যাবে জীববিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানে।
আর ঈশ্বরকে জানা যাবে হিন্দুশাস্ত্রে, গীতায়,উপনিষদে, দর্শনে,পূরাণে।
জ্ঞানযোগ অনেক কঠিন সকলের পক্ষে সম্ভব নয়, সবার জন্য তাই কর্মযোগ বা ভক্তিযোগ।
তথ্যসূত্র: শ্রীমদ্ভগবতগীতা- বন্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
লিখেছেন: নাজিম উদ্দিন